মোনা লিসা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা কালজয়ী চিত্র। তবে এর রহস্য যে সত্যিকারে কি তা জানা যায় নি।
অনেকে মোনালিসার রহস্য অনেকভাবে বর্ণনা করে থাকে। অনেকে বলে মোনা লিসা ভিঞ্চি সাহেবের "মা" এর ছবির আদলে তৈরি। এছাড়াও বলা হয় এটা কোন অন্তঃসত্ত্বা নারীর ছবি( ছবিতে মোনা লিসার হাত রাখার স্টাইল এবং বসার স্টাইল দেখে)।আবার এটিও বলা হয় যে এটি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বন্ধুর স্ত্রী -"লিসা ডেল জিওকোন্ড" এর ছবি। ভিঞ্চির বন্ধু তার স্ত্রীর অন্তঃসত্ত্বা হবার আনন্দে ভিঞ্চিকে তার স্ত্রীর ছবি একে দিতে বলেন।আর তাই ভিঞ্চি মোনা লিসার ছবিটি আঁকেন। এছাড়াও মোন লিসা নামের অর্থ করলে দাড়ায় -" মাই লেডি", আর একারণে বলা হয় এটি ভিঞ্চির স্বপ্নের মানুষ।
এছাড়াও প্যারানরমাল ক্রুসিবেল নামে একটি ওয়েবসাইট দাবি করে মোনা লিসা আসলে একটি ভিনগ্রহের প্রাণি।
এছাড়াও মোনা লিসা ছবিতে রয়েছে সিম্বোলিজাম। যেমন- মোনালিসার চোখে লিখা LV, 72, ইতালিয় ভাষায় লিখা- দ্যা আন্সার ইজ ইয়ার, এছাড়া না বুঝতে পারা অনেক চিহ্ন।
ড্যান ব্রাউন তার "দ্যা দা ভিঞ্চি কোড" বই এ দাবি করেন এটি নারী পুরুষের সংমিশ্রিত ছবি৷ যার নাকের এক পাশ ভিঞ্চি অন্য পাশে নারী। আন্যদিকে মোনা লিসার হাসি আসলে দৃষ্টিভ্রম। ভিঞ্চি সাহেব এমনভাবে জ্যামিতিক উপায়ে এটি এঁকেছেন যা দেখলে মনে হবে এটি হাসছে এবং একদম কাছে গেলে মনে হবে এটি বিষন্ন।
মোনালিসার ছবি পুরোটাই রহস্যে ঘেরা। ছবির এ রহস্যময়ী নারী কে তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অন্তত ডজনখানেক নারীর নাম করা হয় যাদের একজনকে শিল্পী লিওনার্ডো মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বলে দাবি করা হয়।
অল্প কয়েক বছর আগে একজন ফরাসি বৈজ্ঞানিক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে মূল ছবির পিছনে আরেকটি ছবি আবিষ্কার করেছেন। কে জানে, ছবিটির রহস্য উদঘাটনে আর কতদিন গবেষণা চলতে থাকবে?
রহস্যের শেষ নাই। মোনালিসা পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি যাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি লেখা হয়েছে, সর্বাধিক সংগীত রচনা করা হয়েছে, যে ছবির সবচেয়ে বেশি প্যারোডি আঁকা হয়েছে। এর বীমা মূল্য কত জানেন? বাংলাদেশী মুদ্রার পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এত মূল্যবান, এত প্রসিদ্ধ ছবির মডেল যে খুব সুন্দরী তা বলা যাবে না। পঞ্চদশ শতাব্দী, এমন কি বর্তমান সময়ের মাপকাঠিতে, তাকে বড় মাপের সুন্দরী পর্যায়ে ফেলা যায় না। দুটো সৌন্দর্যের প্রতীক তার nai--চোখের পাপড়ি ও কপালে ভুরু। সম্ভবত সে যুগের ফ্যাশন ছিল এরকম।
ছবিটি শুরু থেকেই যে পৃথিবীব্যাপী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তা নয়। এর নাম ছড়িয়ে পড়ে প্যারিসের লুভর মিউজিয়াম থেকে ১৯১১ সালে চুরি হয়ে যাওয়ার পর।
মোনালিসা মত আরো ভালো ছবি যে নাই জোর দিয়ে বলা যাবে না। লিওনার্ডো, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো, ভ্যান গগ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ চিত্রকর যে সব কিছু অনবদ্য ছবি এঁকেছেন সেগুলো মোনালিসার চাইতে কম সৌন্দর্যমণ্ডিত নয়। তবে দশের মুখে জয় বলে একটা কথা আছে। মোনালিসা ছবির ভাগ্যে সেই জয়ধ্বনি উঠেছে। এর একটা অর্থনৈতিক কারণ আছে।
ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় অর্থ উপার্জনের জন্য ছবিটির গুরুত্ব অপরিসীম। যে মিউজিয়ামে রাখা হোক না কেন, লোকজনের ভিড় উপচে পড়তে থাকে। অর্থ সমাগম হয় অভাবিত হারে। সে কারণে চিত্রটির গুনগান যত ছড়িয়ে দেওয়া যায় মিউজিয়াম এবং ছবিটির সাথে অন্যান্য যারা সংশ্লিষ্ট তাদের সবার ততই লাভ।
চুরি ছাড়াও ছবিটির ভাগ্যে জুটেছে নানা রকমের অত্যাচার। ১৯৫৬ সালে বলিভিয়ার এক দর্শক এর দিকে এত জোরে পাথর মারে যে এর কাঁচের পাত্র চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং বাঁ হাতের এক জায়গা কিছুটা ছিটকে যায।
একবার একজন ছবিটির প্রেমে এতই মশগুল হয়ে গেছিল যে ব্লেড দিয়ে টুকরো করে কেটে চুরি করার মতলব এটে ছিল। এর পরেই চিত্রটি বুলেট প্রুফ গ্লাস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। জাপানর টোকিওতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হলে এক মহিলা কালি ছুড়ে মারেন। তার আপত্তি ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য ছবিটি দেখার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এক রাশিয়ান মহিলা ছবিটায় কলম ছুড়ে মারেন। তাকে কেন ফরাসি নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি এ প্রতিবাদ জানাতে।এ দুটোর কোনটাই ছবিটির কোন ক্ষতি করতে পারেনি।
বিতর্ক যতই থাক, চিত্রটি ইতালির রেনেসাঁ আমলে অপূর্ব চিত্র শিল্পের স্বর্ণযুগের একটি উজ্জল প্রতিচ্ছায়া। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছবিটি আঁকা শুরু করেন ১৫০৩ সালে, শেষ করেন ১৫০৬ সালে। তবে, এর পরও আরো ৪-৫ বছর ছবিটির উপর কাজ করেন।
ছবির মডেল কে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে মনে করা হয় তিনি ছিলেন একজন ইটালিয়ান উচ্চ বংশের মহিলা Lisa Gheradin. তার স্বামী Francisco del Giocondo লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে এ কাজ করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
লিওনার্ডো তার শৈল্পিক দক্ষতা দিয়ে মোনালিসাকে মনের মাধুরী দিয়ে উপস্থাপনা করেছেন। এত বছর পরেও মোনালিসাকে জীবন্ত মনে হয়। তার দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত থাকে দর্শকের প্রতি। মোনালিসার চোখের ও ঠোঁটের কিনারায় এক রহস্যময় দ্ব্যর্থবোধক আবহ সৃষ্টি করেছেন। মোনালিসার ঠোটের কিনারায় শিল্পী রহস্যময় অত্যন্ত মৃদু হাসির আভাস প্রস্ফুটিত করেছেন যা ছবিটিকে জগদ্বিখ্যাত করে রেখেছে।