আমাদের বাপ ঠাকুরদারা পুরোনো দিনের কথা উঠলেই আবেগে একদম আপ্লুত হয়ে পড়তেন। তাই ছোট বেলায় তাদের কথা শুনে মনে হতো, ওই মীর জাফরটাই যত নষ্টের গোড়া। ওই ব্যাটা না থাকলে ইংরেজরা সিরাজ-উদ-দৌল্লা র হাতে মার খেয়ে কবেই ল্যাজ গুটিয়ে পালাতো।
তাছাড়া ইস্কুলেও ইতিহাসের বইটা খুব একটা উল্টে পাল্টে দেখিনি। তাই মনের মধ্যে নানা রকম ভুল ধারণা থেকে গেছিলো।
তারপর একটু বড়ো হবার পরে দেখলাম, ইতিহাসে রটনা আর ঘটনার মধ্যে মাঝে মাঝেই বেশ কিছুটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
আজ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ফাঁকে একটু চেষ্টা করছি যদি সেই ফাঁক ফোকর গুলো কিছুটা বোজানো যায়।
রটনা ১: ঔরঙ্গজেব এর মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের পতন আর তারপরই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শুরু।
ঘটনা: ঔরঙ্গজেব এর মৃত্যু হয় ১৭০৭ সালে, তারপর ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান শুরু হয়। এমনকি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরেও মারাঠা সাম্রাজ্য আয়তনে বাড়তেই থাকে। ১৭৬০ সালে বর্তমান ভারতের প্রায় ৭৫% ছিল মারাঠাদের দখলে।
রটনা ২: সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন সুবে বাংলার (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) শেষ স্বাধীন নবাব।
ঘটনা: আলীবর্দী খাঁ ১৭৪০ সালে সুবে বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। তার পরের বছর থেকেই বাংলায় শুরু হয় বর্গী (মারাঠা সাম্রাজ্যের ভাড়াটে সৈন্য) দের উৎপাত।
সেই ছড়াটা মনে আছে তো?
খোকা ঘুমালো
পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
তারপর প্রায় ১০ বছর যুদ্ধ করার পর, ১৭৫১ সালে মারাঠাদের সাথে আলীবর্দী খাঁর সন্ধি হয়। আর সন্ধির শর্ত অনুযায়ী উড়িষ্যা চলে যায় মারাঠা সাম্রাজ্যের অধীনে।

১৭৫১ সালে ভারতের মানচিত্র
রটনা ৩: মির জাফরকে সিরাজ উদ দৌলা খুব বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও মির জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে।
ঘটনা: ১৭৫২ সালে যখন আলীবর্দী নাতি সিরাজ কে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন তখন থেকেই ঘসেটি বেগম, সৌকাত জঙ্গ আর মির জাফর ভেতরে ভেতরে তার বিরোধিতা শুরু করে। তাই ১৭৫৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরই সিরাজ ঘসেটি বেগমকে বন্ধি করলেন, মির জাফর এর জায়গায় মির মদনকে বকশি হিসাবে নিয়োগ করলেন আর সৌকাত জঙ্গকে যুদ্ধে পরাজিত করে হত্যা করলেন।
এই বার মূল প্রশ্নের উত্তরে আসি, আমার মনে হয় মির জাফর, রায় দুর্লভ, উমি চাঁদ’রা ইংরেজ বাহিনীকে সাহায্যের আশ্বাস না দিলে হয়ত পলাশীর যুদ্ধটাই হতো না।
আর পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ জিতলেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তল্পি তল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে যেতো, এমনটাও মনে হয় হতো না।
আসলে সিরাজ শাসক হিসেবে খুব একটা উঁচু দরের ছিলেন না। তাই তার বিরোধী গোষ্ঠীরা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছিল। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিল ইংরেজরা।
সিরাজের থেকে ধারে ও ভারে বহুগুণ শক্তিশালী মারাঠাদের সাথেও ইংরেজরা একই কৌশলে যুদ্ধ শুরু করে। তারপর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ধীরে ধীরে বিশাল মারাঠা সাম্রাজ্যকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গ্রাস করে নেয়।

১৭৯৫ সালের ভারত
আমাদের মধ্যে এই যে ঐক্যের অভাব এটা কিন্তু তার পরেও বহুবার আমাদের ভুগিয়েছে। এর ১০০ বছর পরেও সিপাহী বিদ্রোহের সময় বেশির ভাগ ভারতবাসী মনে করতো, ইংরেজরা তো দেশ টাকে ভালোই চালাচ্ছে। কতো ইস্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রেল স্টেশন বানাচ্ছে। ওই বুড়ো বাহাদুর শাহ জাফর কি দেশ শাসন করতে পারবে?
আরো প্রায় ৫০-৬০ বছর পর খাটো ধুতি পরা এক প্রৌঢ়, স্বাধীনতা, স্ব শাসন এই সব শক্ত শক্ত শব্দ গুলোকে বড়োলোকের বৈঠকখানা থেকে গরীব মানুষদের দাওয়ায় নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
সেই গল্পটা না হয় অন্য সময়ের জন্য তোলা থাক।
কৌশিক রায় একটি চমৎকার প্রশ্ন করেছেন। আমার ইতিহাসের জ্ঞান নেহাতই অল্প, তারই মধ্যে একটু আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছি। আমার মনে হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ব্যবসা করতেই এসেছিলো, শাসন করতে নয়। তারা নিশ্চই জানতো যে, ভারতের মতো একটা বিশাল দেশ শাসন করা ভীষণ ঝামেলার কাজ। কিন্তু তারা এদেশে এসে দেখলো গোটা দেশের শাসন ব্যবস্থাটা ভীষণই নড়বড়ে। কাকে দিয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করাবে, কিছু ঝামেলা হলে কার কাছে নালিশ জানাবে, কিছুই পরিষ্কার না। তাই মূলত ব্যবসার সুবিধের জন্যই, তারা একপ্রকার বাধ্য হয়ে দেশ শাসন করতে লাগলো। যদিও ইংল্যান্ডে থাকা কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার’রা এর বিরোধিতাই করেছিল। আর শেষ পর্যন্ত হলোও তাই, অতো বড়ো একটা কোম্পানি মাত্র ১০০ বছরের মধ্যেই (১৭৫৭-১৮৫৭) লক আউট হয়ে গেলো।
তবে পুরো ভারত কিন্তু সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ব্রিটিশ রাজের দখলে কখনোই ছিল না। নিচের ম্যাপ গুলো দেখলে বোঝা যাবে, ভারতের মাত্র ৫০% সরাসরি ভাবে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। উপযুক্ত বিকল্প আর নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাবে ৫৮৪ জন দেশীয় রাজা আর দেশের জনগণ মন্দের ভালো ব্রিটিশদেরই মেনে নিয়েছিল।



স্বাধীনতার ঠিক আগের ভারতবর্ষ