১. মঙ্গোল সাম্রাজ্যের একটি অংশ ইলখানাতের প্রধান হালাকু খান পারস্য-বাগদাদ-সিরিয়া-লেভান্ত (শাম) দখল করে মিশরে মামলুকদের হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠায় যে কোন রাস্তা দিয়ে তারা পালাতে পারবেনা, তাদের আল্লাহ তাদের বাঁচাতে পারবেনা, তবে যদি তারা বিনা যুদ্ধে বশ্যতা মেনে নেয় তাহলে কিছু হবেনা। যেমন দামাস্কাস কোন প্রতিরোধ না করে বেঁচে যায়। উত্তরে এই মেসেঞ্জারদের গর্দান নেয় মামলুক সুলতান কুতুজ। ফলে যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী হয়৷
নিচের ছবিতে ইলখানাতের অবস্থান দেখুন। আর তার ওপরেই আরেকটি খানাত গোল্ডেন হোর্ডের অবস্থান মনে রাখুন।

২. এ যুদ্ধে মামলুকরা হারলে মক্কা মদিনা কাবা পর্যন্ত অমুসলিমদের অধিকারে চলে যেত তাই কুতুজের পক্ষে সাধারণ মুসলিমদের অনুপ্রাণিত করে অল্প সময়ের মধ্যে সাহায্যকারী মুজাহিদদের নিয়ে বড় বাহিনী প্রস্তুত করা সম্ভব হয়।
৩. হঠাৎ করেই মঙ্গোল সম্রাট মোংকে খান মারা গেলে হালাকু তার বাহিনীর একটা বড় অংশ যেটা প্রায় ৩ ভাগের ২ ভাগ, নিয়ে রাজধানীর দিকে দ্রুত চলে যান ( যুদ্ধের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট) । উদ্দেশ্য উত্তরাধিকার নির্বাচনে অংশ নেয়া।
৪. মামলুকদের সংখ্যা হয় ১৪ হাজার। মঙ্গোলদের ১২ হাজার। ১০ হাজার মঙ্গোল সেনা আর ২ হাজার আর্মেনিয় ও জর্জিয়ান ক্রুসেডার।
৫. হালাকুর চলে যাবার সংবাদের সুযোগ নিতে চান সুলতান কুতুজ ও সেনাপতি বাইবার্স। বাইবার্স দ্রুত ৪ হাজারের এক বাহিনী নিয়ে ফোর্স মার্চ করে গাজা পার হয়ে আসেন, পেছনে পেছনে আসেন সুলতান কুতুজ। ওদিকে মঙ্গোল সেনাপতি কিতবুকা সামনের দিকে অগ্রসর হন এবং বাইবার্সের ক্ষুদ্র বাহিনীর উপস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অবস্থায় এর মুখোমুখি হোন।

৬. এখানে উল্লেখযোগ্য যে কুতুজ আর বাইবার্স কেও আরব ছিলেন না। তুর্কি ছিলেন। কুতুজ এসেছিলেন ইরানের দিক থেকে দাস হিসেবে। আর নীল চোখের বাইবার্স ছিলেন দক্ষিণ পশ্চিম রাশিয়ার কিপচাক তুর্কী।মঙ্গোলদের যুদ্ধপদ্ধতির সাথে তারা সুপরিচিত ছিলেন। যেটা ছিল দূরত্ব বজায় রেখে তীর দিয়ে আক্রমণ করে দূরে সরে যাওয়া আবার ঘুরে এসে তীর মেরে দূরে চলে যাওয়া। বাইবার্স এই পদ্ধতিই ব্যবহার করেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলেন।
কুতুজ ও বাইবার্স

৭. পথ চেনানোর সুবিধার্থে জর্জিয়ান আর আর্মেনিয়ান খ্রিস্টানরা মঙ্গোলবাহিনীর সামনে ছিল। বাইবার্সের ছোট বাহিনী অপ্রস্তুত অগ্রসরমান এই বাহিনীর ওপর তীর ছুড়তে শুরু করে আর যতবারি মোঙ্গলরা বাইবার্সের কাছাকাছি চলে আসে ততবারই বাইবার্স পিছে হটতে থাকে। এভাবে রিপিট হতে হতে পুরো মোঙ্গল বাহিনী পিছনে অর্ধবৃত্তাকারে অবস্থানরত কুতুজের অপেক্ষাকৃত বড় বাহিনীর মধ্যে গিয়ে পড়ে।
৮. কিতবুকা বিপদ বুঝতে পেরে এই বূহ্য ভাঙতে বাম দিক দিয়ে তীব্র আক্রমণ করলে সেই দিকে কুতুজ গিয়ে অবস্থান সামাল দেন। এ সময় নিজের শিরোস্ত্রাণ খুলে ইসলাম ইসলাম ইসলাম বলে চিৎকার করে বাম দিকের সেনাদের মনোবল ধরে রাখেন বলে খ্যাতি আছে। ওদিকে বাইবার্স মধ্যভাগ ও ডানদিক সুসংগঠিত করে পাল্টা আক্রমণ চালান। সম্মুখ হাতাহাতি এই ধরণের যুদ্ধে মঙ্গোলরা মিশরীয়দের থেকে তুলনামূলক দুর্বল থাকায় আর পেরে উঠেনি। এ সময় কিতবুকাকে পালানোর পরামর্শ দেয়া হলে তিনি মৃত্যুই শ্রেয় বলে যুদ্ধের ভিতরে ঢুকে যান আর মারা পড়েন। এরপর অবশিষ্ট মঙ্গোলরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে।
ছবিতে দেখি। পর্যায়ক্রমেঃ

১. বাইবার্সের মুখোমুখি মঙ্গোলবাহিনী

২. বাইবার্সের মেকি পশ্চাদপসরণ

৩. কুতুজের ফাঁদে আটক মঙ্গোল বাহিনী।
৯. এই যুদ্ধে মামলুকদের জয়ের পর মঙ্গোল সাম্রাজ্য বা হালাকু ফিরে এসে মামলুকদের হারাতে পারতো সহজেই। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি। কারণ মঙ্গোলদের আরেক খানাত গোল্ডেন হোর্ডের শাসক বারকা খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ১২৫২ সালে। ১২৫৯ সালে মংকে খানকে চিঠিতে তিনি লিখেন,"সে (হালাকু) মুসলিমদের সব শহর ধ্বংস করেছে। আল্লাহর সহায়তায় আমি তার কাছ থেকে সকল নির্দোষের রক্তের হিসাব আদায় করব।"
১২৬০ সালে মামলুকদের কাছে কিতবুকা পরাজিত হন। ১২৬২ সালে হালাকু-বারকা যুদ্ধ শুরু হয়। এতে দুই পক্ষেই প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১২৬৫ এর দিকে প্রথমে হালাকু আর পরে বারকা মারা গেলে এ যুদ্ধ শেষ হয়। ১২৯৫ এ ইলখানাত আর কিছু বছর পর গোল্ডেন হোর্ড ইসলামকে রাজধর্ম ঘোষণা করে। ইতিহাসবিদরা একমত হয়েছেন যে হালাকুর বিরুদ্ধে বারকার হস্তক্ষেপ মক্কা এবং জেরুজালেমসহ অন্যান্য পবিত্র ভূমির বাগদাদের মতো ভাগ্য হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল।
আর অন্যদিকে সুলতান কুতুজ আততায়ীর হাতে মারা যাবার পর বাইবার্স সুলতান হয়ে একের পর এক ক্রুসেডে জয়ী হয়ে ক্রুসেডারদের প্যালেস্টাইন থেকে বহিষ্কার করেন এবং ক্রুসেডের যবনিকা টানেন৷