নিউট্রিনো একটি আধানহীন, অতিক্ষুদ্র ভরযুক্ত অবপারমাণবিক কণা।
গোত্রঃ
১) কণা পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুসারে প্রধান দুইরকম গোত্র হয়ঃ ফার্মিয়ন আর বোসন। নিউট্রিনোকে ‘ফার্মিয়ন’ গোত্রে রাখা হয় (যেই গোত্রে পড়ে ইলেকট্রন, মিউওন, প্রোটন, নিউট্রন, কোয়ার্ক ইত্যাদি)। এই গোত্রের কণারা ‘ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিকস’ নামক নিয়ম মেনে চলে এবং এদের ‘স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা’ হয় অর্ধসংখ্যার গুনিতক (Half Integers)। নিউট্রিনোর স্পিন ১/২।
২) এছাড়া আরেক নিয়ম অনুসারে একে ‘লেপটন’ গোত্রেও রাখা হয় (এই গোত্রে পড়ে কোয়ার্কদ্বারা গঠিত নয় এমন কণাগুলি যেমন ইলেকট্রন, মিউওন, টাও ইত্যাদি)।
কেন ভূতুড়ে কণা বলা হয়ঃ
কণাদের মধ্যে নিউট্রিনো সবচেয়ে আশ্চর্যরকমের সব ধর্ম দেখায়।
১) (প্রায়) ভরহীনঃ
নিউট্রিনোকে আপাতভাবে ভরহীন মনে হয়। তবে সূক্ষ্ম পরীক্ষায় দেখা গেছে নিউট্রিনোর অত্যন্ত ক্ষুদ্র ভর আছে। ইলেকট্রনেরও ২.৫ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ নিউট্রিনোর ভর যেন থেকেও নেই- ভূতের মত!
২) (প্রায়) মিথষ্ক্রিয়া হীনঃ
কণারা চারটি মূলগত বলের মাধ্যমে মিথষ্ক্রিয়া করতে পারে অর্থাৎ অন্য কণাদের প্রভাবিত করতে পারে বা নিজে প্রভাবিত হতে পারেঃ
মহাকর্ষ,
তড়িৎচুম্বকীয়,
সবল ও
দুর্বল বল।
ক) নিউট্রিনো আধানহীন তাই তড়িৎচুম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া দেখায় না।
খ) কণাজগতে মহাকর্ষ এমনিতেই নগণ্য; নিউট্রিনোর অকল্পনীয় ক্ষুদ্র ভরের কারণে মহাকর্ষ ধর্তব্যের মধ্যেই পড়েনা।
গ) কোয়ার্কবিহীন বলে সবল বলের ক্রিয়াতেও অংশগ্রহণ করে না।
ঘ) বাকী রইল দুর্বল বল। নিউট্রিনো দুর্বল মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নেয় ঠিকই কিন্তু এরকম মিথষ্ক্রিয়া খুব বিরল এবং শনাক্ত করা খুবই কঠিন।
এইসব কারণে মহাবিশ্বে সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হলেও (সর্বোচ্চ আলোর কণা ফোটন) নিউট্রিনোর মিথষ্ক্রিয়া খুব দুর্লভ। প্রায় কোনও প্রভাব নেই অর্থাৎ যেন থেকেও থাকেনা- ভূতের মত!
৩) শনাক্ত করা প্রচণ্ড শক্ত ও অতিউচ্চ ভেদনক্ষমতাঃ
কণা পদার্থবিদ্যা গবেষণায় কোনও কণাকে শনাক্ত করা হয় অন্যের ওপর তার মিথষ্ক্রিয়া লক্ষ্য করে। নিউট্রিনো মিথষ্ক্রিয়া করেই না প্রায়। তাই তাকে ধরতে পারা বা শনাক্ত করা ভীষণ কঠিন। কোনকিছুতেই প্রভাবিত হয়না বলে নিউট্রিনো সমস্ত কিছু ভেদ করে সহজেই চলে যেতে পারে। প্রতি মুহূর্তে বিলিয়ন বিলিয়ন নিউট্রিনো আমাদের দেহ থেকে শুরু করে গোটা পৃথিবীটা, সৌরজগত, গ্যালাক্সি- সবকিছু ভেদ করে চলে যাচ্ছে। ঠিক ভূতের মতই।
৪) রূপবদলঃ
নিউট্রিনো ৩ রকমের হয়ঃ
ইলেকট্রন নিউট্রিনো
মিউয়ন নিউট্রিনো
টাও নিউট্রিনো
দেখা যায় নিউট্রিনো স্থানের মধ্য দিয়ে চলতে চলতেই এই ৩ রূপের মধ্যে একরূপ থেকে আরেকরূপ ধারণ করে। আরও ভালভাবে বললে একরূপ থেকে একাধিক রূপে (থাকার সম্ভাবনা)-র মিশ্রণ হয়ে যায়। ভোল পাল্টানোটা আবার তরঙ্গের মত পর্যায়ক্রমেও হতে পারে। একে ‘Neutrino Oscillation’ বলে। ভূতের মতই আচরণ বইকী!
৫) বামপন্থী কণাঃ
হ্যাঁ নিউট্রিনো তাই-ই। কণা পদার্থবিদ্যায় কণাদের একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা হয় যাকে বলে ‘Chirality’ (কাইরালিটি) বা ‘Helicity’। দেখা যায় (ভরহীন কণা বাদে) সমস্ত কণাদের ক্ষেত্রে গতির অভিমুখ ও স্পিন-এর অভিমুখের মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট সম্পর্ক নেই। ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে একটি কণার আপেক্ষিক গতির অভিমুখ ভিন্ন হয় বলে (কিন্তু স্পিনের অভিমুখ নির্দিষ্ট বলে) কণাদের গতির অভিমুখ ও স্পিনের অভিমুখ পরস্পর একই (একে বলে ‘ডানহাতি আচরণ’ বা Right-handedness) বা বিপরীত (একে বলে ‘বাঁ-হাতি আচরণ’ বা Left-handedness)- উভয়ই হতে পারে।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত জানা সমস্ত কণার মধ্যে (ভরহীন ফোটন বাদে) কেবল নিউট্রিনোর বেলায় দেখা যায়, তাকে যে পর্যবেক্ষকই দেখুক না কেন, নিউট্রিনোর গতির অভিমুখ ও স্পিনের অভিমুখ সর্বদা বিপরীত হয় অর্থাৎ নিউট্রিনো শুধুমাত্র বাঁ-হাতি আচরণ করে। কি সৃষ্টিছাড়া আচরণ রে বাবা!
৬) (হয়ত) নিজেই নিজের বিপরীত কণাঃ
এখনও পর্যন্ত জানা কণাদের মধ্যে কেবল ভরহীন কনা ফোটন (যার গোত্র হল ‘বোসন’, ফার্মিয়ন নয়) নিজেই নিজের বিপরীত কণা। ফার্মিয়নদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত সবারই আলাদা আলাদা বিপরীত কণা আছে। এই ধরণের ফার্মিয়নদের বলে ‘ডিরাক ফার্মিয়ন’। এমন সম্ভাবনা আছে যে নিউট্রিনো হল একমাত্র ফার্মিয়ন যারা নিজেই নিজের বিপরীত কণা। এরকম ফার্মিয়নকে বলা হয় ‘মায়োরানা ফার্মিয়ন’। এখন পর্যন্ত আলাদা একটি কণা ‘অ্যান্টিনিউট্রিনো’কে নিউট্রিনোর বিপরীত কণা মনে করা হয়। নিউট্রিনো-অ্যান্টিনিউট্রিনোতে তফাৎ কেবল বাম/ডানহাতি আচরণে। তাই যদি নিউট্রিনোর ডানপন্থী রূপ পাওয়া যায় তবে বলা যাবে এযাবৎ জানা অ্যান্টিনিউট্রিনো আসলে আলাদা কণা নয় বরং নিউট্রিনো নিজেই- কেবল ডানপন্থী। সেক্ষেত্রে তা হবে একমাত্র ফার্মিয়ন যা নিজেই নিজের বিপরীত কণা। আবার অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, যদি বা ডানপন্থী নিউট্রিনো পাওয়াও যায় তা অনেকটা অন্যরকম হবে- অ্যান্টিনিউট্রিনোর মত হবে না। সেক্ষেত্রে নিউট্রিনোকে মায়োরানা ফার্মিয়ন নাও বলা যেতে পারে।
এইরকম সব অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কারণে আর রহস্যময় বলে বলে একরত্তি নিউট্রিনোকে নিয়ে মাঝেমাঝেই বিজ্ঞানীদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়! তাই একে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভূতুড়ে কণা’।